ঢাকা , সোমবার, ০৫ মে ২০২৫ , ২১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে বাঘ-সিংহের খাদ্য বাসি গরুর মাংস সরবরাহ লালমনিরহাটে সেপটিক ট্যাংকে শ্রমিকের মৃত্যু বিরলে সর্প দংশনে ২ জনের মৃত্যু নওগাঁয় গৃহকর্মী থেকে সফল হাঁসচাষি খাতিজা সাঘাটায় বাঙালি নদীতে বালু উত্তোলন হুমকিতে ব্রিজ ও ফসলি জমি শেরপুরে অধ্যক্ষ নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশে বাধা বাবুগঞ্জে বাঁধ নির্মাণ সংরক্ষণের জিও ব্যাগ ডাম্পিং কাজের উদ্বোধন জমা পড়েছে দায়সারা প্রতিবেদন তিন লাশের পরিচয় মেলেনি ডেঙ্গুতে মৃত্যু নেই হাসপাতালে ৪৩ রোগী আসন্ন বর্ষায় এবারও ঢাকা ডুবে যাওয়ার শঙ্কা এবার পাল্লা ভারী করার মিশনে বিএনপি রফতানিতে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা ৫ মে থেকে আন্দোলনে নামবেন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা ‘কর্মীদের আর্থিক নিরাপত্তা ছাড়া গণমাধ্যম স্বাধীন হবে না’ ফেব্রুয়ারি কিংবা এপ্রিলে নির্বাচন হওয়া উচিত-শফিকুর রহমান তারেক রহমানের খালাসের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি আজ ঢাকায় ব্যবসা খুঁজতে আসছে চীন জুলাইয়ের বিপক্ষ শক্তি হামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে- প্রেস সচিব আ'লীগের পুনর্বাসন মানবো না অন্তর্বর্তী সরকারকে কড়া বার্তা দিলো হেফাজত

ধানের ন্যায্যমূল্য নিয়ে শঙ্কায় কৃষক

  • আপলোড সময় : ০৪-০৫-২০২৫ ০৬:৪৭:০৯ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ০৪-০৫-২০২৫ ০৬:৪৭:০৯ অপরাহ্ন
ধানের ন্যায্যমূল্য নিয়ে শঙ্কায় কৃষক
* ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় সুনামগঞ্জের কৃষকরা
* হাওরে ধানের বাম্পার ফলন হলেও দাম নিয়ে হতাশা
* যে কারণে সরকারকে ধান দিতে অনীহা কৃষকের
* ধান-চাল সংগ্রহ কম, আমদানি বেশি
* নতুন সোনালি পাকা ধানের গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ


পুরোদমে দেশজুড়ে চলছে বোরো মৌসুমের ধান কাটা। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলনও হয়েছে ভালো। নতুন চাল বাজারে আসায় কমতে শুরু করেছে চালের দাম। তবে ধানের দাম কমে যাওয়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কৃষকরা। ধান কাটা পুরোদমে শুরু হওয়ায় দাম আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। তবে কৃষকরা বলছেন, সরকারি গুদামের চাহিদা অনুযায়ী ধান প্রস্তুত করতে গেলে প্রতি মণে আরও ৫-৭ কেজি কমে যায়। এছাড়া সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে বাড়তি পরিবহন খরচ, বিক্রয়ে অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ নানা প্রক্রিয়াগত জটিলতায় পড়তে হয়। এ কারণে খোলাবাজারেই ধান বিক্রি করছেন অনেকে।
সপ্তাহের ব্যবধানে মিল ও পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম কেজিতে ২-৫ টাকা কমেছে। খুচরা বাজারে এখনও এই দাম কমার প্রভাব পড়েনি। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরোদমে বাজারে বোরো চাল এলে দাম আরও কমে আসবে। এবার সেচের পানি, সার, বীজ, কীটনাশক ও ধান কাটার খরচ ৩০ শতাংশ বেড়েছে। বর্গা চাষ করলে এক কেজি ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে সাড়ে ৩৫ টাকার বেশি। তবে সরকার বলছে, আগের বছরের চেয়ে দাম বাড়িয়ে ৩৬ টাকায় কিনবে তারা। এই দরে বেচলেও তো আমাদের লোকসান হবে। এই দুঃখ মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার ধূল্যা গ্রামের চাষি রহমান আলীর। শুধু রহমান আলী নন, এবারও ধান-চালের ভালো দাম পাওয়া নিয়ে কৃষকের মনে জমা শঙ্কার মেঘ কাটছে না। কৃষি উপকরণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় ধানের দাম বাড়ার পরও কৃষক লোকসানের শঙ্কায় পড়েছেন।
দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তা অটুট রেখে মজুত বাড়াতে প্রতিবছর স্থানীয় বাজার থেকে সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করে। এই সংগ্রহ অভিযানের উদ্দেশ্য সরাসরি কৃষকের পাশে দাড়ানো এবং ভোক্তাকে স্বস্তি দেয়া। এই বোরো মৌসুমে ৩৬ টাকা কেজি দরে সাড়ে ৩ লাখ টন ধান কেনা হবে।  আর ৪৯ টাকা কেজি দরে সেদ্ধ চাল কেনা হবে ১৪ লাখ টন। গেল বোরো মৌসুমে ১১ লাখ টন সেদ্ধ চাল, ১ লাখ টন আতপ চাল এবং ৫ লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। ওই সময় প্রতি কেজি ধান ৩২ টাকা ও সেদ্ধ চাল ৪৫ টাকা ছিল। এবার আমন মৌসুমে সরকার ৫.৫০ লাখ টন সেদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। সংগ্রহ হয়েছে ৪.৩৫ লাখ টন। আতপ চাল সংগ্রহ হয়েছে ৮৪ হাজার ৬১ টন। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ টন। চাল মূলত মিলাররা দেন। ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩.৫০ লাখ টন। সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ২৬ হাজার ৭১৪ টন। বাজারদরের চেয়ে সরকার নির্ধারিত সংগ্রহ মূল্য কম হওয়ায় আমন মৌসুমে খাদ্য অধিদফতর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে অভ্যন্তরীণ ঘাটতি পূরণে সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার ৮ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্য ঠিক করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, গত ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ৫.১৮ লাখ টন চাল আমদানির দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে, যার বেশির ভাগ এরই মধ্যে দেশে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণায় বলা হয়, দেশে বছরে চাহিদার চেয়ে প্রায় ৪২ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। উদ্বৃত্ত থাকার পরও চাল আমদানির কারণ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সরকারের ধান-চাল সংগ্রহে ব্যর্থতা, পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করা এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাল আমদানি করতে হয়। ব্রির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে শুধু শতভাগ ধান-চাল সংগ্রহ করতে পেরেছে সরকার। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ২১ শতাংশ, ২০২০ সালে ৩৩ ও ২০২১ সালে ৫৪ শতাংশ ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়।
সেচ যন্ত্রের জ্বালানি ডিজেল ও বিদ্যুতের দামের পাশাপাশি বেড়েছে সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি। এতে বোরো ধান চাষে খরচও বাড়ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হিসাবে, বোরো ধানের উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে কৃষকের ধান ও চালের ভালো দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কা আছে। গাইবান্ধা সদর উপজেলার কৃষক আবদুর রহমান বলেন, এবার বোরো ধান চাষে প্রতি বিঘা জমিতে বাড়তি প্রায় ৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। গত বোরো মৌসুমে এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে বোরো উৎপাদনে খরচ ছিল প্রায় ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এ বছর তা দাঁড়াবে ১৮ হাজারেরও বেশি। একইকথা বলেছেন মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার কৃষক মাহফুজুল হক। তিনি বলেন, হিসাব অত সোজা না। এই ধরেন, যদি আমি নিজের জমি চাষ করি, তা হইলে হিসাব এক রকম। আর যদি অন্যের জমি বর্গা নিই, তা হইলে খরচ আরও বেশি। ধান সংগ্রহে এখনকার পদ্ধতিতে কিছু অসংগতির কারণে কৃষক ভোগান্তিতে পড়ছেন। গুদামে ধান বিক্রি করতে গিয়ে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। তবে ব্যবসায়ীর কাছে ধান বিক্রিতে তেমন বেগ পেতে হয় না। সরকারি গুদামে ধান দিতে গেলে অনেক সময় ফিরিয়ে দেয়া হয়। তাতে দুই দফা পরিবহন খরচ হয়। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরবাটা ইউনিয়নের ভূঁইয়ার হাটের কৃষক দুলাল চন্দ্র দাস বলেন, সরকারের কাছে অ্যাপস ও ব্যাংকের মাধ্যমে ধান বেচতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়। আর্দ্রতা পরীক্ষার নামে হয়রানি তো আছেই। চাল ও ধান ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালা আছে। এতে ১৫টি শর্ত দেয়া আছে মিলার ও কৃষকদের জন্য। কুষ্টিয়ার আলামপুর এলাকার কৃষক এনামুল হক বলেন, গুদামে ধান নিয়ে গেলে আর্দ্রতা মাপা হয়। ভেজা হলে সেই ধান আবার শুকাতে হয়। এর পর ওজনে কম হলে আবার বাড়ি থেকে বাড়তি ধান এনে সেটা পূরণ করতে হয়। গাড়ি ভাড়া নিজের পকেট থেকে দিতে হয়। আবার চেক নিয়ে ব্যাংকে যেতে হয়। সরকার যদি প্রতি ইউনিয়ন থেকে ধান কেনে, তাহলে ভালো হয়। তার কথার সঙ্গে মিলি রয়েছে কুষ্টিয়ার বিত্তিপাড়া এলাকার কৃষক রহিম মণ্ডল ও আবেদ আলীর। তিনি বলেন, মৌসুমের শুরুতেই প্রান্তিক কৃষক টাকার জন্য কম দামে ধান বিক্রি করেন। সেই ধান ফড়িয়া ও ছোট ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে মিল মালিকদের কাছে চলে যায়। কৃষকদের ঘরে যখন কোনো ধান থাকে না, তখন দাম বাড়তে থাকে। হাওরে এখন ধানের মণ ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে। এখন বড় বড় মিল মালিকরা কম দামের এসব ধান কিনে গুদাম বোঝাই করতে শুরু করেছেন।
সুনামগঞ্জের হাওরে পুরোদমে চলছে ধান মাড়াইয়ের কাজ। ধান কাটা আর কেনাবেচা নিয়েও আলোচনা মুখে মুখে। তবে উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন কৃষকরা। তারা ধারণা করছেন, সরকার প্রতিমণ ধানের মূল্য ১ হাজার ৪৪০ টাকা নির্ধারণ করলেও, হয়তো সেটি পাবেন না। রাজনীতিবিদ ও কৃষক সংগঠকদের পরামর্শ সরকার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এবং বেশি সংখ্যক কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে পারলেই কেবল ধানের নির্ধারিত মূল্য পাবেন কৃষকরা। অর্থাৎ মিলার ও ফড়িয়ারা তখন বাধ্য হবে উপযুক্ত মূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনতে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সুনামগঞ্জের গ্রামাঞ্চলে এখন জোরেশোরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার পর্যন্ত হাওর ও হাওরের বাইরের খেত মিলিয়ে ৫৫ শতাংশ ধান কাটা ও মাড়াই করা হয়েছে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পাশাপশি খরচের জন্য ধান বিক্রয়ও করছেন কৃষকরা। এক্ষেত্রে বিপদগ্রস্ত কৃষকরা মিলার ও ফড়িয়াদের কাছে কম দামে অগ্রিম বিক্রয় করছেন ধান। আবার কেউ কেউ অপেক্ষা করছেন, সরকার ধান কেনা শুরু করলে ধানের দাম কিছুটা বাড়তে পারে, তখনই ধান বিক্রি করবেন তারা।
বিশ্বম্ভরপুরের করচার হাওরপাড়ের মুক্তিখলার এক কৃষক জানান, ধান কাটানোসহ অন্যান্য খরচ চালানোর জন্য ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম এনেছি। তাদের কথা দিয়েছি শুকনো ধান দেব প্রতিমণ ১০০০ টাকা দরে। একই এলাকার আরেক কৃষক মহিবুর রহমান বলেন, সাত কেয়ার (তিন কেয়ারে এক একর) জমিতে ধানচাষ করেছেন তিনি। এরমধ্যে চার কেয়ার বর্গা (আধা আধি দেবার চুক্তিতে) করেছেন। চার কেয়ার শ্রমিক দিয়ে কেটেছেন, সাত ভাগে একভাগ দেবার চুক্তিতে। ধান পেয়েছেন প্রতি কেয়ারে ২২ মণ। সব মিলিয়ে ১৫০ মণের মতো ধান পাবেন তিনি। ১৫ থেকে ২০ মণ ধান বিক্রয় করবেন। সরকার ধান কেনা শুরু করলে গোডাউনে এক টন দেবার চেষ্টা করবেন। না হলে মহাজনের আড়তে নিয়ে যাবেন ১৫ থেকে ২০ মণ ধান। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার মনুয়া গ্রামের কৃষক আনিসুল হক চৌধুরী বলেন, একজন কৃষক দেড় মণ ধান বিক্রি করতে পারবেন। মাত্র দেড় মণের জন্য বাড়ি থেকে উপজেলা সদরে ধান নিয়ে বিক্রি করে গাড়ি ভাড়া, নৌকা ভাড়া ও শ্রমিকের খরচ দিয়ে লাভ থাকবে না। আরও নানান জটিলতা রয়েছে। এ কারণে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছি।
জামালগঞ্জের বেহেলী ইউনিয়নের রহিমাপুরের কৃষক মুকুল রায় বলেন, ব্যাপারী (ধান কাটার শ্রমিক) মিলাইতে পারিনি। কাল-পরশু কাটানোর চেষ্টা করবো। ভরতপুর থেকে শ্রমিক আনার চেষ্টা করছি। তারা বলেছে কেয়ারে ৩০০ টাকা নগদ এবং সাত ভাগের এক ভাগ দিতে। হাওরে হারভেস্টার মেশিন (ধান কাটার যন্ত্র) নামে না। এজন্য বিপদে পড়েছি। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পর শুকিয়ে, আমরা দুই তিন ভাই মিলে দুই তিন টন ধান বিক্রি করবো। সরকারি গুদামে দিতে পারলে ভালো হত। এর আগে কোনো সময়ই দিতে পারিনি। একইকথা বলেছেন তাহিরপুরের বড়দলের সামায়ুন আহমদ। তিনি বলেন, বিগত সময়ে ৫০ থেকে ৬০ জনের কৃষি কার্ড একজন নিয়ে গেছে। এই টাউটরাই ধান দিয়েছে। খাদ্য গোদামে ধান দিতে গেলেও তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে আমাদের বিদায় করেছে। এবার যদি সুযোগ পাই খাদ্য গোদামে ধান দেবার চেষ্টা করবো। সামায়ুন জানান, বারো কেয়ার (এক হাল) জমি করেছেন। ছয় কেয়ার জমির ধান কেটেছেন, বাকী আছে ছয় কেয়ার। সব মিলিয়ে ২৫০ মণ ধান পাবেন।
হাওরের কৃষি ও কৃষক বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি চিত্ত রঞ্জন তালুকদার বলেন, সরকারি ক্রয় কেন্দ্রের পরিবেশই থাকে ফড়িয়া দালালদের পক্ষে। এটি বদলাতে হবে। হাওরে দাদনি (কম দামে অগ্রিম ধান কেনা) এবারও মহাজনেরা কোটি কোটি টাকা ছেড়ে দিয়েছে। এছাড়া ক্রয়কেন্দ্র দূরবর্তী স্থানে হওয়ায় অনেক কৃষক সেখানে যেতে চায় না। উপজেলা ধান ক্রয় কমিটি, ইউনিয়ন কৃষি সুপারভাইজারদের সহায়তা নিয়ে শুকনো ধান যাচাইবাছাই করে ফড়িয়া বা মিলারদের মতো এলাকায় এলাকায় ট্রাক নিয়ে গিয়ে কিনতে পারে। এক্ষেত্রে পরিবহন ভাড়াও কৃষকরাই বহন করবে। তাতে সমস্যার কিছু দেখছি না। এবারও শুনেছি চার পাঁচশ’ টাকা দিয়ে কৃষি কার্ড নিয়ে যাচ্ছে ফড়িয়া টাউটরা। এটি বন্ধ করতে সকলকে সক্রিয় হতে হবে।
সুনামগঞ্জের ধান চাল ক্রয় কমিটির সদস্য সচিব জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হুমায়ুন কবির বলেন, মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, কারণ স্থানীয়ভাবে ধান ক্রয় করে মজুত করা ও উপজেলা সদরের খাদ্য গুদামে আনার জন্য পরিবহন ব্যবস্থা নেই আমাদের।
মাথার ওপর কড়া রোদ। হাওরজুড়ে এলোমেলো তপ্ত হাওয়া। নতুন সোনালি পাকা ধানের গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ। তপ্ত এই রোদের মধ্যেই যেন অন্যরকম উৎসব সবখানে। চলছে ধান কাটা। কিশোরগঞ্জে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে দাবি করেছে কৃষি বিভাগ। তবে কৃষকরা বলছেন, দীর্ঘ খরা না থাকলে ফলন আরও বেশি হতো। এদিকে বেশির ভাগ ধান পেকে যাওয়ায় দ্রুত কাটা হচ্ছে। শ্রমিকরা ব্যস্ত রয়েছেন ধানকাটার কাজে। তবে ফলনে খুশি হলেও দামে হতাশা রয়েছে কৃষকদের। তবুও হাসি মুখেই কেটে যাচ্ছেন পরিশ্রমের ফসল। আর ধীরে ধীরে বাড়ছে কপালে চিন্তার ভাঁজ। লাভ তো দূরের কথা, খরচের টাকা উঠবে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন!
জেলার নিকলী উপজেলার বড় হাওরে পুরো পরিবার নিয়ে ধান সংগ্রহে ব্যস্ত কৃষক আবুল কালাম। খরচ কমানোর জন্য স্ত্রী, তিন ছেলে ও শিশুকন্যাকে নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে ধান কেটেছেন তিনি। এখন চলছে ঝাড়াইয়ের কাজ। তিনি জানালেন, ফলন ভালো হলেও খুশি হতে পারছেন না দামে। এ দামে ধান বিক্রি করে দেনা-পাওনা মিটিয়ে কিছু থাকবে কিনা সেটাই ভাবনার বিষয়। আরেক কৃষক মজনু মিয়া ফলন কেমন হয়েছে এমন প্রশ্নে জানালেন, এ বছর পাঁচ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছেন। ফলনও বেশ। রোদে পুড়ে ফলানো ফসল বিক্রির সময় দাম না মিললে এমন ফসল ফলিয়ে কী হবে? প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি। কিছুটা চুপচাপ থেকে আবার বলতে শুরু করলেন, স্ত্রী, সন্তান, বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে কীভাবে বছরের বাকি সময়টুকু পার করবো, কীভাবে ঋণ মেটাবো, সেই ভাবনাই এখন সারাদিন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হাওর অঞ্চলসহ পুরো জেলাতেই এখন একই দৃশ্য। দলবেঁধে ধানকাটা, মাড়াই আর রোদে শুকানো চলছে একসঙ্গে। বসে নেই নারী ও শিশুরাও। এরই মধ্যে হাওর অঞ্চলে ৬৫-৭০ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। কৃষি বিভাগের পরামর্শ, ৮০ ভাগ পাকলেই যেন কেটে ফেলা হয় সব ধান। এ বছর কেবল হাওর অঞ্চলেই ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন ধান কাটায়। কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ধান কাটার যন্ত্র কাজ করছে ৪১৩টি। ফলে দ্রুতবেগে চলছে ধান কাটা। শ্রমিক হিসেবে অন্যের জমিতে ধান কাটছেন কামরুল মিয়াসহ ১২ জনের একটি দল। কামরুল বলেন, আগে একাই কাজ করেছি। কিন্তু এখন দল বেঁধে কাজ না করলে পোষায় না। এক হলো, কৃষক ধান উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রি মেলাতে পারছেন না। অন্যদিকে শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিতেও তাদের হিমশিম খেতে হয়। বিভিন্ন যন্ত্রপাতির কারণে দিনদিনই কমছে ধানকাটার শ্রমিক। হাতের কাজে অনেক সময় লাগে। মূলত ছোট ছোট ক্ষেতের কৃষকরাই আমাদের কাজে লাগান। আর যাদের সক্ষমতা আছে, তারা মেশিনে ধান কাটায়।
এবার নতুন জাতের ধানই বেশি চাষ করেছেন কৃষকরা। পুরনো জাতের মধ্যে ব্রি-ধান ২৯-ও দেখা গেছে অনেক ক্ষেতে। নতুনের মধ্যে ব্রি-ধান ৮৮, ৮৯, ৯২, ৯৮ এবং হাইব্রিডসহ সব ধানেরই ভালো ফলন হয়েছে। এ বছর বন্যায় ধান তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকলেও ভারিবৃষ্টি হলে ব্যাঘাত ঘটবে ধান কাটায়। এ কারণে দ্রুত ধান কাটায় মনোযোগী সবাই। শুরুতে ধানের দাম এগার শ’ টাকা থাকলেও এ দাম এখন অনেকটা কমে গেছে। বর্তমানে ৪০ কেজি কাঁচা ধান বিক্রি হচ্ছে ৯৩০ থেকে ৯৫০ টাকা দরে। কৃষকদের অভিযোগ, ধান চাষে খরচ হয় বারো শ’ টাকার মতো। আর দীর্ঘ খরার কারণে এবার সেচে খরচ হয়েছে অন্যবারের চেয়ে দ্বিগুণ। এভাবে লোকসান দিলে ধান চাষে আগ্রহ হারাবেন তারা। সরকারের উচিত ফসলে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. মো. সাদিকুর রহমান জানান, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরোচাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। চাষ হয়েছে আরও কিছু বেশি জমিতে। কেবল হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে এক লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। এসব চাল জেলার চাহিদা মিটিয়ে সারা দেশে পাঠানো যাবে বলেও মনে করছেন তারা। সব ঠিকঠাক থাকলে মে মাসের ১০ তারিখের মধ্যেই হাওরের সব ধান কাটা হয়ে যাবে বলে আশা কৃষি বিভাগের।
এ বিষয়ে কথা হয় সাবেক খাদ্য সচিব আবুল কাশেম এর সঙ্গে। তিনি বলেন, চাল উৎপাদনে বোরোর অবস্থান শীর্ষে। অথচ এই মৌসুমে গত বছরের চেয়ে দেড় লাখ টন কম ধান সংগ্রহ করা হবে। এতে কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি না করে খোলাবাজারে বেশি দামে বিক্রি করতে আগ্রহী হবে। চালকল মালিকরা ধান কিনতে বাজারে আসার আগেই সরকার ব্যবস্থা না নিলে আগের মতো এবারও ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। গত ১২ এপ্রিল দেশের ৪৩ বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে বলেছেন, কৃষককে বঞ্চিত করে মিলারদের সুবিধা দিতে ধান সংগ্রহের পরিমাণ কমানো হয়েছে। ১৩ এপ্রিল সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্ট এক বিবৃতিতে বলেছে, ধান-চাল কেনার এই সিদ্ধান্তে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারও যে অতীতের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতেই পরিচালিত হচ্ছে, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তবে খাদ্য সচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেন, ধানের উৎপাদন খরচের ভিত্তিতে ধান-চাল সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করে সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয় সেই খরচ নিরূপণ করে। এবার চাল আমদানি হয়েছে পর্যাপ্ত। ধান কিনলে সেটা ভাঙানো ও মজুত সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে খাদ্য অধিদফতরের। ধানের দাম এবার ৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়ানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কৃষক বিক্রি করতে গেলে দাম কমে যাওয়া এবং কৃষকের হাত থেকে পণ্য ব্যবসায়ীদের হাতে গেলে দাম বেড়ে যাওয়া এটা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রেই আমরা এটা দেখি। ফলন ভালো হলেও কৃষক লোকসানে থাকেন। এরজন্য আসলে একক কোনো সমাধান নেই। কৃষকের হারভেস্ট করার পর তাৎক্ষণিক টাকার প্রয়োজন হয়, এ কারণে তিনি কম দামে বিক্রি করে দেন। তার সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে না। যদি সংরক্ষণের সুবিধা এবং এর জন্য ঋণ ব্যবস্থা চালু করা যায়, তাহলে একটা সমাধান আসবে। তবে এর জন্য বড় অঙ্কের বাজেট প্রয়োজন হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, এবার আবহাওয়া ভালো ছিল, এ কারণে ফলনও ভালো হয়েছে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবার সরকারিভাবে কেজিতে ৪ টাকা বেশি দাম দিয়ে ধান সংগ্রহ করা হবে। তবুও কিছু সমস্যা থেকে যায়। তবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে কাজ করে যেতে হবে।
 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স